Loaded

Stories

শহীদদের স্মরণে নির্মিত এই ভবনটির ফ্ল্যাটও হস্তান্তর করা হয় একটি বিশেষ দিনে

শহীদদের স্মরণে নির্মিত এই ভবনটির ফ্ল্যাটও হস্তান্তর করা হয় একটি বিশেষ দিনে

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আহমাদুর রহমানসহ স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রাণ দেওয়া বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত ভবনটির ফ্ল্যাটগুলো গ্রাহকদের হস্তান্তরের জন্যও বেছে নেওয়া হয়েছিল একটি বিশেষ দিন। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয় র৵াংকস এফসি প্রপার্টিজ লিমিটেড

 

৩০ লাখ শহীদের রক্তে জন্ম নিয়েছিল নতুন দেশ। অর্জিত হয়েছিল লাল–সবুজের নতুন পতাকা। বাংলার প্রতি ইঞ্চিতে মিশে আছেন জীবন উৎসর্গকারী সেই বীর যোদ্ধারা। তাঁদের ঋণ তো শোধ করা যাবে না। তবে স্মরণ তো করা যায়। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সেই অর্জনের কথা যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বেঁচে থাকে, সেই ভাবনা থেকেই বহুতল ভবনটির নাম রাখা হলো ‘মেমোরি ৭১’। চট্টগ্রাম নগরের দামপাড়ার এম এম আলী সড়কে সগৌরব দাঁড়িয়ে আছে ১০ তলা ভবনটি। এর নির্মাণ সৌন্দর্য পথচলতি মানুষও ঘুরে দেখতে বাধ্য হন।

ভবনের সম্মুখদেয়ালে যেন জীবন্ত হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামমুখর দিনগুলো। দৃষ্টিনন্দন ভবনটির শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ম্যুরাল।

 

 

চট্টগ্রামে এই ব্যতিক্রমী ভবন নির্মাণ করেছে দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ র৵ানকনের আবাসন প্রতিষ্ঠান র৵াংকস এফসি প্রপার্টিজ লিমিটেড। একসময় এখানে ছিল একটি দোতলা বাড়ি। সেখানে থাকতেন আহমাদুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে যিনি দেশের জন্য দিয়েছিলেন প্রাণ। কালের পরিক্রমায় তার স্মৃতি ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল। সেই পুরোনো ১০ কাঠা জায়গার ওপর এখন দাঁড়িয়ে আছে ১০ তলা ভবন। বসবাস করছে ১৬টি পরিবার।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আহমাদুর রহমানসহ স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রাণ দেওয়া বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত ভবনটির ফ্ল্যাটগুলো গ্রাহকদের হস্তান্তরের জন্যও বেছে নেওয়া হয়েছিল একটি বিশেষ দিন। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয় র৵াংকস এফসি প্রপার্টিজ লিমিটেড। মাত্র ২৭ মাসে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।

 

যেভাবে ‘মেমোরি ৭১’

এম এম আলী সড়কের পাশে থাকা ভবনটি একসময় প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ছিল। গলির মুখের এই বাড়ি ধীরে ধীরে হয়ে পড়ে জীর্ণ। সামনেই ছিল নালা। নালার সঙ্গে লাগোয়া সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন, দিনের বেশির ভাগ সময় সেখানে ময়লা–আবর্জনা উপচে পড়ত। ময়লার গন্ধে হাঁটাচলা দায়। দিনদুপুরে ঘটত নানা অপরাধ।

এ রকম একটি জায়গায় বহুতল ভবন করার জন্য বেছে নেয় আবাসন প্রতিষ্ঠান র৵াংকস। প্রকল্প এলাকাজুড়ে এসব বিশৃঙ্খলা নিয়ে দুর্ভাবনায় ছিলেন প্রতিষ্ঠানের কর্তারাও। তবে তাঁরা হাল ছাড়েননি। কোনোরকমে ভবন নির্মাণ করে গ্রাহকদের বুঝিয়ে দিয়ে সরে আসবেন, এই সহজ পথে হাঁটেননি তাঁরা।

প্রকল্প ঘিরে নিলেন ভিন্ন পরিকল্পনা, ভিন্ন চিন্তা। পরিকল্পনার মূল ভাবনায় ছিল একাত্তর আর মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর শাহরিয়ার জানালেন, ময়লার ভাগাড় হয়ে পড়ে জায়গাটা। এ রকম একটা জায়গায় ফ্ল্যাট তৈরি করে কোনোরকমে হস্তান্তর করে গেলেই কি চলবে? মানুষের মনে একটা ধাক্কা দিতে চেয়েছি। চেয়েছি মনস্তত্ত্বে পরিবর্তন আনতে।

এই কাজে যে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন, সেটা এখন সেখানকার পরিবেশ দেখলেই বোঝা যায়।

প্রকল্পের নামকরণ নিয়ে শুরুতে চলে মগজমারি। জায়গার মালিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আহমাদুর রহমানের স্ত্রী মরিয়ম রহমান ভবনের নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘রক্ত ঋণ’। তবে তানভীর শাহরিয়ার যুক্তি দিয়ে বোঝালেন, ‘মেমোরি ৭১’ রাখলেই বৃহৎ পটভূমি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসকে ধারণ করা সম্ভব হবে। তানভীরের যুক্তি খুশিমনে মেনে নিলেন মরিয়ম রহমান। নাম ঠিক হলো ‘মেমোরি ৭১’।

নামকরণের সার্থকতা ধরে রাখতে সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর মো. গিয়াস উদ্দিনের সহযোগিতায় সরিয়ে ফেলা হয় ডাস্টবিন। নালার ওপর স্ল্যাব বসিয়ে সবুজে ঢেকে দেওয়া হয়। ভাঙাচোরা ফুটপাতকে করে তোলা হয় ব্যবহারের উপযোগী। প্রাচীরের গায়ে ম্যুরালের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় একাত্তরের দিনগুলো। একসময়ের প্রায় পরিত্যক্ত জায়গাটি এখন এলাকাবাসীর গৌরবের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যুরালের সামনে দাঁড়িয়ে একাত্তরের স্মৃতি মুঠোফোনের ক্যামেরায় জমা করেন এলাকাবাসী থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারীরা।

যেখানে ব্যতিক্রম র৵াংকস

এ তো গেল ভবনের নামকরণ ও ইতিহাসের কথা। নামকরণের পর আসে নকশা করার পালা। র৵ানকনেরই ডিজাইন প্রতিষ্ঠান ইনস্পেস নেয় সে দায়িত্ব। ইনস্পেসের প্রধান নির্বাহী স্থপতি ওয়াহিদুর রহমান বলেন, ‘নকশা প্রণয়নের শুরুতেই পরিকল্পনা ছিল, এলাকার অন্য সব ভবন থেকে যেন এই ভবনের ভিন্নতা বোঝা যায়। দূর থেকে দেখলে যেন সহজেই চেনা যায়, এটা র৵াংকসের করা ভবন। সেই ভাবনা ধরেই নকশা শুরু করি আমরা।’

ভবনের নকশায় যুক্ত করা হলো সামনের দেয়ালজুড়ে সবুজের সমারোহ। নাগরিক কোলাহল আর ইট–সিমেন্টের নগরে সবুজের হারিয়ে যাওয়ার গল্পই শুধু জন্মেছে। এ অবস্থায় হারিয়ে যাওয়া সতেজ সবুজ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন স্থপতিরা। দেশে আগেও ভার্টিক্যাল গার্ডেন হয়েছে, তবে ভবনের সামনে ৯৫ ফুট উঁচু ভার্টিক্যাল গ্রিন তৈরি করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন তাঁরা।

ফার্ন, গ্রিন মনস্ট্রেরা, ইয়েলো মনস্ট্রেরা দিয়ে টেকসই একটি সবুজ ভবন তৈরির সেই চ্যালেঞ্জ জয় খুব সহজ ছিল না।

তবে ইনস্পেসের ডিটেইল সল্যুশন আর র৵াংকসের নিজস্ব কলাকৌশলের মাধ্যমে অবশেষে টেকসই এই সবুজ দেয়াল দাঁড়িয়ে যায়। অটোমেশনের ব্যবহার যোগ করে মিলেছে বাড়তি সুবিধা।

তানভীর শাহরিয়ার জানান, প্রথমে জিওটেক্স ট্রেতে মাটি দিয়ে ‘ভার্টিক্যাল গ্রিন’ তৈরি করা হয়। এতে সফলতা আসে ৬০ শতাংশ। এরপর জিওটেক্স ব্যাগ দিয়ে চলে পরীক্ষা। তাতে ৯৫ শতাংশ সফলতা আসে। গাছ নিয়েও কম পরীক্ষা–নিরীক্ষা হয়নি। প্রথমে ফার্ন ও এডিলিয়া দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত গ্রিন মনস্ট্রেরা ও ইয়েলো মনস্ট্রেরা দিয়ে সবুজ দেয়াল তৈরি করা হয়। এই গাছগুলো দেখতে সুন্দর, বেঁচেও থাকে লম্বা সময়। পরিচর্যার খরচ একদম কম।

সবুজ দেয়ালের পরীক্ষা সফল হওয়ার পর চারপাশ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন বলে জানান তানভীর শাহরিয়ার। তিনি বলেন, ‘আমাদের এ ধরনের সাফল্য দেখে অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা পরিদর্শনে আসেন। টিমওয়ার্কের কারণে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এখন সবুজ দেখার উপলক্ষ হয়েছে ভবনটি।’

কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলে প্রথম কোপটাই পড়ে গাছের ওপর। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ছিল ‘মেমোরি ৭১’। একটি গাছও কাটা হয়নি। বরং গাছ না কেটে কী করে ভবন নির্মাণ করা যায়, সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল তারা। এখনো ভবনটিতে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে ৫৫ বছরের পুরোনো শিরীষগাছটি। রয়েছে অন্যান্য গাছও। চারপাশে লাগানো হয়েছে রেঙ্গুন বাঁশ। বাঁশঝাড় যেন ফিরিয়ে এনেছে গ্রামীণ আবহ। ভবনের নিচতলায় রয়েছে জেন গার্ডেন। যেখানে সকালে বসে অনেকেই মেডিটেশন বা ধ্যান করেন। ওপরে রয়েছে ব্যায়ামাগার ও আধুনিক লাউঞ্জ। চারদিকে প্রশস্ত পথ।

মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবনায় রেখে এমন ভবন কি আর তৈরি হয়েছে বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে? সেটা জানা নেই তানভীর শাহরিয়ারেরও। এ কারণেই ভবনটি নিয়ে একধরনের গর্ব হয় তাঁর।