Loaded

Stories

আলোঝলমলে চট্টগ্রামের লাইটহাউস - মুনির হাসান

আলোঝলমলে চট্টগ্রামের লাইটহাউস - মুনির হাসান

যে কয়টা উদ্দেশ্য নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছি, এটি তার একটি। আগে থেকে ঠিক করে রেখেছি, অন্ধকার নামলেই কেবল সেটি দেখতে যাব। গাড়ি গোলপাহাড় মোড় থেকে মেহেদীবাগের দিকে মোড় ঘোরাতেই সুন্দর দৃশ্যটি ফুটে উঠল। ফেসবুকের ছবিতে যেমন দেখেছি, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি সুন্দর। আশপাশের বাড়িগুলোর তুলনায় মনে হবে আলোর বন্যা। এলাকার লোকেরা যে একে ‘দ্য লাইটহাউস অব মেহেদীবাগ’ বলেন, তাতে কোনো অত্যুক্তি হয় না। ফেসবুকে ভবনের আলোময় একটি ছবি দেখার পর থেকে ইচ্ছা ছিল, এটি দেখতে যাব।

ভবনটি নির্মাণ করেছে রেনকন এফসি প্রপার্টিস। এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর শাহরিয়ার রিমনকে তো চিনি। কাজেই ফোন করে বললাম, ‘আপনার লাইটহাউস দেখতে যাব।’ রিমন বললেন, তিনি নিজেই আবাসিক ভবনটি ঘুরিয়ে দেখাবেন। যতই সামনে এগোলাম, ততই সৌন্দর্যের আভা টের পাচ্ছিলাম। যথারীতি বাইরে অপেক্ষা করছিলেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। বাড়ির সামনেই এক–দুটা গাড়ি রাখার জায়গা। সেখানেই নেমে পড়লাম। ভবনের প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার প্রবেশদ্বার। ভেতরে ঢোকার মুখেই, অভ্যর্থনা লাউঞ্জের বাইরের ওয়ালজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে রেইন ফরেস্ট।

সেখানে কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা। তারই হাল্কা পানির ছটা গায়ে লাগল। ওয়াটার বডির গা বেয়ে গ্রিন আর ইয়েলো মনস্ট্রেরা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ভার্টিক্যাল ফরেস্ট। সেখান থেকেই অটোমেটেড পানির ধারা নেমে আসে টাইমার–নিয়ন্ত্রিত নির্দিষ্ট সময় পরপর। পানিতে চোখ আটকে গেল জীবন্ত মাছের সঙ্গে শাপলা ফুলের খেলা দেখতে। মাছগুলো কি আমাকে দেখেই নাচতে শুরু করেছে? নিচতলার অভ্যর্থনা লাউঞ্জের ঠিক সামনে বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বার্ডস অব প্যারাডাইজের বন। এই বনের মধ্যে থেকে বের হয়েছে একটা বিরাট কাণ্ডওয়ালা কাঠগোলাপ।

ঢোকার সময়ে দেখে নিয়েছি বাড়ির নাম—হোয়াইট ওক!!! ও লাইটহাউস তাহলে নাম নয়। নামের বিষয়ে কিছু জানতে চাওয়ার আগেই রিমন জানালেন, সাদা রঙের দেয়ালে ভার্টিক্যাল গ্রিনওয়াল—এই কনসেপ্ট থেকেই হোয়াইট ওক। ১৫ তলা ভবন যদিও বা, এটি উচ্চতায় ১৭৮ ফুট।

দোতলায় উঠতেই দেখা গেল অভিনব এক লাউঞ্জ। অ্যাপার্টমেন্টের মালিকদের ব্যবহারের জন্য অনেক সুবিধাদি নিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। অন্যান্য অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের মতো কেবল একটা আড্ডার জায়গা নয়, বরং এখানে আছে বুক কর্নার, কফি কর্নার, আলাদা মিটিং জোন। কেউ কেউ ইচ্ছা করলে ছুটির দিনে টুকটাক দাপ্তরিক কাজও সেরে নিতে পারবেন। আমার মনে হলো, ভবনের বাসিন্দারা এখানে ছোট একটি বিজনেস সেন্টারও গড়ে নিতে পারবেন।

 

দোতলার লাউঞ্জ দেখে ভাবলাম, ওপরে যাই। ছাদে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায় সবুজে। দুই লেভেলে দুটো ছাদ। লেভেল ১৪-তে এমএস ফ্রেইমে জিও ব্যাগ পটে মাটি দিয়ে ফার্ন, গ্রিন মনস্ট্রেরা, ইয়েলো মনস্টেরা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে টেকসই গ্রিনওয়াল। পানি দেওয়ার জন্য অটোমেটেড ইরিগেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। লেভেল ১৪-তে আরও একটি লাউঞ্জ চোখে পড়ল। যেখানে দিনের বেলা কোনো লাইট জ্বালাতে হয় না বলেই মনে হলো। কারণ, স্কাইলাইট আসার জন্য রাখা হয়েছে বিশাল পাঞ্চ। সেই পাঞ্চে টেম্পার্ড গ্লাস বসানো হয়েছে।

১৩ তলায় ফিটনেস সেন্টার। সেখানে কম–বেশি সব ইকুইপমেন্টসহ একটি জিম রাখা হয়েছে। জিমে ওয়ার্কআউট শেষে সেখানেই যেন শাওয়ারটা সেরে নেওয়া যায়, তার ব্যবস্থাও রয়েছে। পাশে বড় টেরেসে একটি মাইন্ডফুলনেস জোন তৈরি করা হয়েছে। একটি বড় সিলোন লোহা গাছকে আস্ত কেটে এনে সিজন করে আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানেও আছে একটা বড় রেইন ফরেস্ট। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা এখানে ইয়োগা, অ্যারোবিকসের পাশাপাশি মেডিটেশন করেন।

 

 

তানভীর শাহরিয়ার রিমন বলেন, ‘ভবন তো সবাই বানায়, আমরা তৈরি করি আর্টপিস।’ তিনি বলেন, এই ভবন তৈরিতে পরিবেশের ক্ষতিকারক কোনো নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়নি। ইকো ফ্রেন্ডলি ভার্টিক্যাল গ্রিন, এনার্জি এফিশিয়েন্ট জানালা, সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মাধ্যমে ভবনটিকে একটি পরিবেশবান্ধব ভবন হিসেবে তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে।

 

রিমনের কাছ থেকে জানা গ্রিন ভবন তৈরিতে তাদের প্রতিষ্ঠান অনেক দিন ধরে কাজ করছে। তাঁর দাবি, চট্টগ্রামে তাঁরাই প্রথম গ্রিন বিল্ডিং বা পরিবেশবান্ধব নির্মাণ শুরু করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো গ্রিন প্রকল্প তাঁরা হস্তান্তরও করেছেন। যার মধ্যে মেমোরি সেভেন্টিওয়ান, হোয়াইট ওক, পার্ক ট্যারেস, কাসা ক্রাউন উল্লেখযোগ্য।
গ্রিন কারখানার মতো গ্রিন বিল্ডিং বা সবুজ স্থাপনা সাধারণভাবে প্রচলিত কোনো প্রত্যয় নয়, এটি একটি আন্দোলনের নামও বটে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পৃথিবীকে টেকসই করতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতেই এই আন্দোলন।

 

একটি দালান বা ভবনকে সবুজ দিয়ে রং করে দিলেই সেটি যেমন গ্রিন বিল্ডিং হয়ে ওঠে না বা কিছু গাছ লাগিয়ে দিলেই সেটি পরিবেশবান্ধব হয়ে যায় না। গ্রিন বিল্ডিং হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, ভবনের কাজে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রীগুলোকে অবশ্যই কম কার্বন নিঃসরণকারী, তথা পরিবেশবান্ধব হতে হবে। বর্তমানে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত প্রচলিত ইটগুলো ইটভাটায় টপ সয়েল (উর্বর মাটি) পুড়িয়ে প্রস্তুত করা হয়, যা একদিকে যেমন কৃষিজ জমি হ্রাস করছে, তেমনি ইটভাটার কয়লা নিঃসৃত কালো ধোঁয়া কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনছে। এগুলো দিন দিন দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

 

রিমন জানালেন, একটি সবুজ নগরী গড়ে তোলার স্বার্থে ভবনের নির্মাণকাজে অ্যারিয়েটেড অটোক্ল্যাভ কংক্রিটের ব্যবহার করা দরকার। এই ব্লক তৈরিতে পরিবেশের ক্ষতিকর কোনো উপাদান ব্যবহৃত হয় না। সেই সঙ্গে এটি প্রথাগত ইটের চেয়ে তিন গুণ হালকা। এটি ভবনের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া অধিক পরিমাণে নবায়ণযোগ্য সৌরশক্তির ব্যবহার, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা, এনার্জি এফিসিয়েন্ট উইন্ডো, ভার্টিক্যাল গ্রিনওয়াল নির্মাণ, ওয়েস্ট রিডাকশনের বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। ঘুরে দেখতে দেখতে আমার মনে হলো, নির্মাণের সময় তাঁরা এসব বিষয় নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। জুন মাসের তপ্ত রাতেও ভবনের ভেতরে তাপমাত্রা দুই থেকে তিন ডিগ্রি কম মনে হয়েছে। রিমনও বললেন, তাপমাত্রা আসলেই কম।

 

তানভীর শাহরিয়ার রিমন জানালেন, তাঁরা ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানো, রিসাইক্লিংয়ের যোগ্য নির্মাণসামগ্রীর বেশি ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ম্যাটেরিয়াল বর্জন করার চেষ্টা করবেন। এর পাশাপাশি সব রকম অপচয় কমাতে তাঁরা সচেষ্ট থাকবেন।

আমরাও আশা করি, আমাদের ভবন নির্মাতারা কার্বন অফসেট কমিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শহরকে বাসযোগ্য ও টেকসই রাখার জন্য পরিবেশবান্ধব সবুজ বাড়ি বানাতে সচেষ্ট হবেন।